জাতি গড়ার কারিগরের উপাধিই শিক্ষক। তাইতো সকলেই শিক্ষকদের পথপ্রদর্শক,দর্শন তত্ত্বের একজন মস্ত বড় পন্ডিত মনে করেন।
সংবিধানের ৩১ ও ৩২ ধারায় মানুষের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এটি সত্য।কিন্তু এটির মানে এটা নয় যে নিয়ম অন্যের জন্য আমি নিয়মের ব্যতিক্রম।বরং এমন ধারনা সংঘবদ্ধ সমাজে বিশৃংখলা তৈরি করবে।অথচ সংবিধানের এ ধারা অপব্যবহার করে
আজ জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষকদের নানা ভাবে লাঞ্চিত করছে একদল হায়েনা।তাদের জন্য কখনোই আইন কার্যকর হয়না।তারই জ্বলন্ত উদাহরন সাম্প্রতিক সংঘটিত ছাত্রের পিটুনিতে শিক্ষক হত্যার নিকৃষ্ট উদাহরন।
বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিকতাও শৃংখলা ফেরাতে গিয়ে প্রশাসন কর্তৃক যেমনি শিক্ষক লাঞ্চনা বাড়ছে ,তেমনি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক,প্রশাসনিক কর্মকর্তা , ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এবং ছাত্রদের দ্বারা (সর্বশেষ দশম শ্রেণীর ছাত্র দ্বারা ২৫ শে জুন, ২০২২) হরহামেশাই লাঞ্চিত হচ্ছেন এদেশের শিক্ষকরা।পত্রিকা খুললেই দেখা যায় প্রতিষ্ঠান সভাপতি,শিক্ষা কর্মকর্তা,প্রশাসনিক কর্মকর্তা,ছাত্র, হীন অভিভাবকের হাতে অতীতে প্রায়ই লাঞ্চিত হয়েছেন,বর্তমানে হচ্ছেন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান প্রধান কিংবা স্নাতক/ স্নাতকোত্তরধারী শিক্ষকরা।
অথচ একটা সময় আর্থিক নিরাপত্তা না থাকলে ও শিক্ষকরা কতই না সন্মান পেতেন,আজ আর্থিক নিরাপত্তা অনেকখানি বাড়লেও শিক্ষকরা পদে পদে অপমানিত।প্রায় ১৯০ বছরের বৃটিশ শাসনামলে এবং প্রায় ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসনকালে শিক্ষকের মর্যাদার তেমন উচ্চাসিন হয়নি বললেই চলে।স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি গত ৫১ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষকের মর্যাদা অনেকটাই উচ্চাসীন। বাংলাদেশে এক সময় শিক্ষকদের কোন বেতনই ছিলনা। ঐসময় শিক্ষক বলতে বুঝাতো অতিশয় ভদ্র,চোখে ভাঙা চশমা,পরনে কম দামী কুচকানো পাজামা পাঞ্জাবি কিংবা লুঙ্গি, পায়ে সাধারন জুতা কিংবা সেন্ডেল,হাতে সাধারন ছাতা কিংবা তালি দেওয়া ছাতা। ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ সরকার শিক্ষকদের জন্য মাসিক পাঁচ (০৫) টাকা ভাতা চালু করে ।সেই থেকে শিক্ষকদের বেতন -ভাতা শুরু।স্বাধীনতা পরবর্তী শেখ মুজিবুর রহমান সরকার এক সাথে ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ০১ লক্ষ ৬২ হাজার শিক্ষকের চাকুরী জাতীয়করণ করেছিলেন।ব্যস, তখন থেকেই শুরু। তারপর সরকারিকরন, জাতীয়করন,এমপিওভুক্তির কার্যক্রম।বিশাল পথ অতিক্রম করে শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যপক পরিবর্তন ঘটলেও শিক্ষকদের অধিকার , কর্তব্য ও সন্মানের প্রশ্নে শিক্ষা ব্যবস্থায় আজও নানাবিধ সমস্যায় ভরপুর।এখনি প্রতিরোধ না করলে কিংবা যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে সে লাঞ্চনা অব্যাহত থাকবে।
গত কয়েক বছরের পরিসংখানে দেখা যায় যে,
গত শনিবার (২৫ জুন,২০২২) দুপুর ২টার দিকে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠ প্রাঙ্গণেই দশম এক শিক্ষার্থীর অতর্কিত হামলায় নিহত হন সেই বিদ্যালয়ের পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের শিক্ষক এবং শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি উৎপল কুমার সরকার ।
গত ৭ জুন ২০২২ চাঁদপুর ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিতুবা শামসুল ওদুদিয়া দাখিল মাদ্রাসার ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক হযরত আলীকে মাদ্রাসা ম্যানেজিং কমিটির প্রথম সভায় অনিয়মকে কেন্দ্র করে গুরুতরভাবে আহত করা হয়।
লক্ষীপুরে ১৬জুলাই ২০১৯ রোজ মঙ্গলবার মাছিমপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোঃ কামাল হোসেন প্রকাশ পিচ্চি কামালের হাতে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমির হোসেনকে লাঞ্চিত করা হয়।
১৮ আগস্ট, ২০১৯ নওগাঁয় বিদ্যালয় সভাপতি কর্তৃক প্রধান শিক্ষক লাঞ্ছিত হয় ।২৫ এপ্রিল, ২০১৮ বাগেরহাটের মোল্লাহাটের শহীদ হেমায়েত উদ্দিন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আম্বিয়া জামানকে বিদ্যালয়ের সভাপতি হারুন শিকদার কর্তৃক লাঞ্চিত করা হয়।বগুড়ার নন্দীগ্রামে কোশাস উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শামিম হোসেনের ঘুষিতে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাজ্জাদুল ইসলামের দাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে গত ৭ ই অক্টোবর২০২১ । এসিল্যান্ড কর্তৃক করোনাকালে পিটিয়ে হাত ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল একজন কলেজ প্রভাষকের।গত ৯ অক্টোবর গোপালগঞ্জে উন্নয়নের টাকায় ভাগ না দেওয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনোজ কান্তি বিশ্বাসকে মারধর করেছেন উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির লোকজন।এদিকে ছাত্রদের শৃংখলিত করতে , নিয়মানুবর্তিতা শেখাতে,নৈতিকতা কমিটির রুটিন মাফিক কাজ বাস্তবায়ন করতে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শৃংখলা রক্ষা করতে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ইং রোজ রবিবার ১৪জন ছাত্রদের চুল কাঁচি দিয়ে কর্তন করে সাময়িক অপদস্ত হয়েছেন এবং চাকরি হারিয়েছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ফারহানা ইয়াসমিন ।
শিক্ষার্থী চড় মারায় ১০ ই অক্টোবর ২০২১ রোজ রবিবার রাজধানীর রমনার খ্যাতনামা উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক নাসির উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্থ করা হয়েছে।
অন্যদিকে ৬ ই সেপ্টম্বর লক্ষীপুরে ছয় মাদ্রাসা ছাত্রের কাঁচি দিয়ে চুল কর্তন করে পুলিশের কাছে গ্রেফতার হয়েছেন হামছাদী কাজীর দিঘীর পাড় আলিম মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক মঞ্জুরুল কবির ।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করা হয় যে ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ পরিণত হবে।সেটি হয়েছে ও অনেক ক্ষেত্রে।ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দশ লাখ থেকে দশ কোটি হয়েছে।শিক্ষার হার এই সময় দ্বিগুন হয়েছে।কিন্তু সাম্প্রতিক বাজেট ২০২২-২০২৩ থেকে স্পষ্ট হয় যে, হয়নি শিক্ষকদের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক মর্যাদা। প্রতিদিনই শিক্ষক লাঞ্চনার খবর ভেসে আসে।
প্রতিনিয়তই অশিক্ষিত,মধ্য শিক্ষিত অযোগ্য লোকের কমিটি দিয়ে হরহামেশাই চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।অথচ দেশে স্নাতকধারী শিক্ষিত বেকারের অভাব নেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ।কয়েক বছর আগে ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের জরিপে বলা হয়েছিল, বিশ্বে বাংলাদেশেই শিক্ষিত বেকারের হার সর্বোচ্চ।প্রতিবেদন বলছে, দেশে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা বেকার যুবকের সংখ্যা ৪ লাখ ১০ হাজারের বেশি। একদিকে স্নাতকধারী লক্ষ যুবক বেকারত্বের গ্লানি বহন করছে অন্যদিকে অষ্টম শ্রেণী পাস, এস এস সি পাস কম শিক্ষিতরা এখনো স্নাতকধারী শিক্ষকদের পরিচালনা করছে।এটিই কী শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশর অর্জন?২০১৯ সালে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়া সভাপতি নয় বলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই বিধান চালু হলো। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানিজিং কমিটির ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়নি।এখন শোনা যাচ্ছে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির যোগ্যতা এসএসসি করার পরিকল্পনা করছে সরকার। শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের এহেন ভুল ভাবনা আমাদেরকে চরমভাবে ভাবিয়ে তুলছে নি:সন্দেহে।
তাই পরিশেষে বলতে চাই শিক্ষকের লাঞ্চনা দূর করতে,ছাত্র,প্রশাসন,পুলিশ এবং ম্যানেজিং কমিটির হাতে শিক্ষক নিপীড়ন বন্ধ করতে,শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিত করতে, শিক্ষকদের সন্মানজনক পেশা সৃষ্টি করতে,অভিভাবকদের উৎকন্ঠা দূর করতে,ধূমপানকারী,মাদকাসক্ত,দূনিতিবাজ,অস্ত্রধারী কিংবা তার চেয়ে নোংরা পরিবেশ সৃষ্টিকারীদেরকে দূরে রাখতে, শিক্ষাবিদদের সন্মান ঠিক রাখতে,আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে,শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিকতা চালু রাখতে এখনি অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করে শাস্তি নিশ্চিত করা আজ সময়ের দাবী।একই সাথে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শিক্ষকদের উপর শাস্তি,হয়রানিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন ও শিক্ষক লাঞ্চনা বন্ধ করা ও সময়ের উত্তম দাবি। এমনটি না হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সপ্ন এবং উদ্দেশ্য বারো আনাই অসম্পূর্ন থেকে যাবে।
লেখক ও কলামিস্ট
ফিরোজ আলম,বিভাগীয় প্রধান(অনার্স,এম এ শাখা)।
আয়েশা( রা:) মহিলা কামিল(অনার্স,এম.এ) মাদ্রাসা,সদর,লক্ষীপুর।
মেম্বার কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটি,সাধারন সম্পাদক , লক্ষীপুর জেলা শাখা এবং সিনিয়র সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি,বিএমজিটিএ ।alamferoz4525@gmail.com