প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থাকবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।বাজেটে প্রাধান্য পেয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কৃষি খাত, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ ও কর্মসংস্থানসহ বেশ কিছু খাত।তবে শিক্ষাখাত অবহেলিত ই রয়ে গেল।২০২২-২৩ সালের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা অর্থাৎ মোট বাজেটের প্রায় ১১.৯৪ শতাংশ।যা গত ২০২১-২২ অর্থ বছরে ছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা অর্থাৎ মোট বাজেটের প্রায় ১১.৯১ শতাংশ ।এবারের শিক্ষা বাজেট গত অর্থ বছরের তুলনায় টাকার অংকে মোট ৯ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা বেড়েছে যা আনুপাতিক হারে ০.৩ শতাংশ বেড়েছে । ২০২২-২৩ সালের এই বাজেট ২০১৬/১৭ বাজেটের তুলনায় ২.৪৮ শতাংশ ও ২০১৭/১৮ বাজেটের তুলনায় ০.৮০ শতাংশ কমেছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ২০২২-২৩ সালের জন্য ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা গত ২০২১-২২ অর্থ বছরে ছিল ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য এবার ২০২২-২৩ সালের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা গত ২০২১-২২ অর্থ বছরে ছিল ৩৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য এবার ২০২২-২৩ সালের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা গত ২০২১-২২ অর্থ বছরে ছিল ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা।
গত তের বছরের শিক্ষা বাজেট বিশ্লেষনে দেখা যায় ২০১২ সালে মোট বাজেট ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ১৯৮১০ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১২.১১শতাংশ ২০১২-২০১৩ সালে মোট বাজেট ছিল ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮কোটি টাকা তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ২১৪১৭ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১১.১৭শতাংশ,২০১৩-২০১৪ সালে মোট বাজেট ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ২৫০৯৬ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১১.২৮শতাংশ 2014-2015 ২০১৪-২০১৫ সালে মোট বাজেট ছিল ২লাখ ৫০ হাজার ৫০৬কোটি টাকা তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ২৯২০৮ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১১.৬৬শতাংশ, ২০১৫-২০১৬ সালে মোট বাজেট ছিল ২লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ৩১৬০৫ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১০.৭১শতাংশ, ২০১৭-২০১৮ সালে মোট বাজেট ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা, তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ৪৯০১২ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১৪.৩৯শতাংশ,এটিই গত দশ বছরে আনুপাতিক হারে সর্বচ্চো শিক্ষা বাজেট । ২০১৭-২০১৮ সালে মোট বাজেট ছিল ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা ,তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ৫০৪৩৩ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১২.৬৬শতাংশ। ২০১৮-২০১৯ সালে মোট বাজেট ছিল ৪লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩কোটি টাকা, তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ৫৩০৫৪ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১১.৫৩শতাংশ, ২০১৯-২০২০ সালে মোট বাজেট ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০কোটি টাকা, তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ৬১১১৮ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১১.৭৪শতাংশ।
২০২০-২০২১ সালে মোট বাজেট ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ৬৬৪০১কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১১.৬৯ শতাংশ।
২০২১-২০২২ সালে মোট বাজেট ৬ লাখ তিন হাজার ছয় শত একাশি (৬০৩৬৮১) কোটি টাকা, তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে একাত্তর হাজার নয় শত পঞ্চান্ন কোটি টাকা (৭১৯৫৫) টাকা যা মোট বাজেটের ১১.৯১ শতাংশ।
২০২২-২০২৩ সালে মোট বাজেট ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা (৬০৭৮৬৪) কোটি টাকা, তার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে একাশি হাজার চারশত ঊনপঞ্চাশ কোটি টাকা (৮১৪৪৯) টাকা যা মোট বাজেটের প্রায় ১১.৯৪ শতাংশ।
এবারের বাজেটে মাদ্রাসা ও কারিগরি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৭২৭ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১.৫৯ শতাংশ এবং মোট শিক্ষা বাজেটের ১২ শতাংশ। যা গত ২০২১-২২ অর্থ বছরে ছিল ৯১৫৩ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ১.৫১ শতাংশ এবং মোট শিক্ষা বাজেটের ১২.৭২ শতাংশ।
বাজেটে তুলনামূলকভাবে কারিগরি ও মাদ্রাসায় বরাদ্দ কম ই রাখা হয়েছে।আর মাদ্রাসার বরাদ্দতো তো সর্বনিন্ম। যা মাদ্রাসার টেকসই,গুনগত ও মান সম্মত শিক্ষার প্রসারে এবং মানোন্নয়নে প্রধান বাধা হবে সন্দেহ নাই।
এবারের বাজেটে শিক্ষাখাত উপেক্ষিত হয়েছে সন্দেহ নাই।যার ফলে সরকারি শিক্ষকদের প্রত্যাশা এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কাঙ্খিত জাতীয়করন,যত্নে লালিত শতভাগ উৎসব ভাতার স্বপ্ন,সন্মানজনক বাড়ি ভাড়ার প্রত্যাশা,উপযুক্ত চিকিৎসা ভাতা,পেনশন ভাতা সহ ন্যায্য অধিকারের লাভের পথ বন্ধই হয়ে গেল।সাথে সাথে শিক্ষা নিয়ে সরকারের সূদূরপ্রসারী দীর্ঘ মেয়াদি ভাবনা,পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ যে লোক দেখানো তা স্পস্ট হল।
সাধারণত ইউনেস্কো প্রেসক্রাইব করে যে, সুন্দর-শিক্ষিত একটা দেশ গড়ার জন্য বাজেটে জিডিপির ন্যূনতম ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া উচিত।অথচ এবারের বাজেটে যা ২.৬ শতাংশ।পৃথিবীতে এমন একটা দেশের উদাহরণ পাওয়া যাবে না, যারা জিডিপির ৪ শতাংশের নিচে বরাদ্দ রেখে শিক্ষায় উন্নত হয়েছে। সারা বিশ্বে গবেষণা ও উন্নয়ন নামে আলাদা একটা খাত আছে। যা শিক্ষা খাতের বাইরে। বিশ্বে ১২৫টার মতো দেশ আছে যারা এই খাতে প্রতি বছর অন্তত এক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। দেখা গেছে এই খাতে যারা যত বেশি ব্যয় করে, তারা তত বেশি উন্নত। সেই তালিকায় নেপাল আছে। কিন্তু বাংলাদেশ নাই। কারণ এই খাতে আমাদের কোনো বরাদ্দই রাখা হয় না।’
করোনায় সুযোগ-সুবিধার অভাবে দুই তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীকে বাহিরে রেখে অনলাইন ক্লাশ হয়েছে।
অন্যদিকে করোনা পরবর্তী শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাশ নিশ্চিত করার জন্য দরকার ছিল পর্যাপ্ত পরিমান অবকাঠামো নির্মান। শিক্ষার্থীদের ইক্যুইপড করার জন্য বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা জরুরি ছিল।অথচ শিক্ষায় স্বল্প বাজেটের কারনে তাও হলোনা।
শিক্ষা খাতে সাড়া ও আশাজাগানিয়া বাজেট ও বিনিয়োগের কৃপনতার কারনে প্রবৃদ্ধির আশাজাগানিয়া উন্নতির সুফল দীর্ঘ মেয়াদে পাওয়া যে সম্ভব হবেনা তা এবারের শিক্ষা বাজেট থেকে স্পস্ট হয়েছে।কিছু মানুষ কথায় ভারতের উদাহরন নিয়ে আসে।মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে আমরা নাকি ভারতের থেকে উন্নত। তাহলে অন্তত ভারতে শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দটা দেওয়া হয়, সেটাই আমাদের দেওয়া হোক। যদিও ভারতেও বরাদ্দ অপ্রতুল।’
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আজকের এই সময়ে দক্ষ ও সৃজনশীল জনবল অপরিহার্য।অথচ এবারের শিক্ষা বাজেট এখানেই ব্যর্থ। আজকের বাংলাদেশে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হল জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত,নৈতিক শিক্ষায় বলিয়ান, দক্ষ, কর্মঠ,সৃজনশীল, প্রগতিশীল ও উদ্ভাবনী চেতনার এমন মানবসম্পদ সৃষ্টি করা, যারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে এদেশের জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারবে।কিন্তু এবারের ২০২২/২০২৩ অর্থ বাজেটে শিক্ষা খাতে যে হারে বরাদ্দ রেখেছে তাতে লালিত স্বপ্নের ফলাফল অর্জন স্বপ্নেই থেকে যাবে।বছরের পর বছর শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ রাখার ফলাফল হিসেবে বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে (নলেজ ইনডেক্স) আমরা হতবাক হয়ে দেখেছি যে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। আমাদের ওপরে নেপাল, দেউলিয়া ঘোষিত শ্রীলঙ্কা, ভূটান, ভারত, অস্থির পাকিস্তান—সবাই। উচ্চ শিক্ষা খাত কিংবা প্রাথমিক শিক্ষার দিক থেকে আমাদের অবস্থান আরও নিচে। বছরের পর বছর শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম রেখে একটা বোকা জাতি বানানোর খেলা আমাদের এখনি বন্ধ করতে হবে।
তাই বলবে শিক্ষা বাজেট অনতিবিলম্বে পরিবর্তন করুন।টাকার অংকে বাজেট বেশি দেখিয়ে শিক্ষক সমাজকে বিভ্রান্ত করবেন না,শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করবেন না।বরং মোট বাজেটের আনুপাতিক হারে ২০ শতাংশ শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ রেখে শিক্ষকদের কাঙ্খিত জাতীয়করন,শতভাগ উৎসব ভাতা,সন্মানজনক বাড়ি ভাড়া,উপযুক্ত চিকিৎসা ভাতা,পেনশন ভাতা সহ ন্যায্য অধিকারের লাভের পথ উন্মুক্ত করুন। না হলে এদেশ ,এজাতি যেমনি জ্ঞানপাপী অধিকার হরনকারী শোষকদের ক্ষমা করবেনা,আইনেস্টাইনের যোগ্য উত্তসূরীদের বঞ্চনার কারনে তেমনি মেধা আর জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়বে পুরো বাংলাদেশ।
লেখক ও কলামিস্ট
ফিরোজ আলম,বিভাগীয় প্রধান(অনার্স,এম এ শাখা)।
আয়েশা( রা:) মহিলা কামিল(অনার্স,এম.এ) মাদ্রাসা,সদর,লক্ষীপুর।
মেম্বার কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটি,সাধারন সম্পাদক , লক্ষীপুর জেলা শাখা এবং সিনিয়র সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি,বিএমজিটিএ।