সময়ের নুর ডেস্ক :
নোয়াখালী সায়েন্স অ্যান্ড কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ ড. আফতাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। চাকরিপ্রার্থী ওই তরুণীর দায়ের করা মামলায় পুলিশের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে ঘটনার সত্যতাও মিলেছে। শুক্রবার (১৩ আগস্ট) ওই তরুণীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট রবিউল হাসান পলাশ জানান, আগামী ১ সেপ্টেম্বর মামলার একমাত্র আসামি ড. আফতাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের তারিখ নির্ধারণ রয়েছে। অধ্যক্ষের দায়ের করা মানহানির মামলার জবাবও দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
ভুক্তভোগী ওই তরুণীর ভাষ্যমতে, মাইজদীতে নোয়াখালী সায়েন্স অ্যান্ড কমার্স কলেজের নতুন ক্যাম্পাসে কয়েকজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, এক বান্ধবীর কাছে এমন খবর পেয়ে চাকরির সন্ধানে ২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি ওই কলেজে যান। কলেজের অধ্যক্ষ ড. আফতাব ওই বান্ধবীর আত্মীয়। সেই সূত্রে কলেজে গিয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ওই তরুণী। পরে ৪ ফেব্রুয়ারি ড. আফতাব ওই তরুণীকে ফোন করেন এবং ভালো চাকরি পাইয়ে দেয়ার কথা বলে আকারে-ইঙ্গিতে আপত্তিকর নানা প্রস্তাব দেন। সেই কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
‘ক্যারিয়ারে ওপরে ওঠার জন্য’ শারীরিকভাবে আপস করার এবং তাতে রাজি থাকলে ওই তরুণীকে বিদেশি ডেলিগেট ও সমাজের প্রতিষ্ঠিত লোকদের কাছে পাঠানোর প্রস্তাব দেন অধ্যক্ষ। তার প্রস্তাব সন্দেহজনক মনে হওয়ায় প্রথমে লাইন কেটে দেন তরুণী। পরে অধ্যক্ষ আবার ফোন করেন এবং অশ্লীল ও আপত্তিকর কথা বলতে থাকেন। পরে এই কথোপকথন রেকর্ড করে রাখেন ওই তরুণী।
এ ঘটনার পর ওই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি অধ্যক্ষকে একটি চিঠি পাঠিয়ে ক্ষমা চাইতে বলেন যৌন হয়রানির শিকার তরুণী। মৌখিকভাবে পুলিশ সুপারসহ জেলার দায়িত্বশীল ও গণমান্য ব্যক্তিদেরও বিষয়টি তিনি অবহিত করেন। কিন্তু ড. আফতাব তাতে সাড়া না দেয়ায় ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার মাধ্যমে একটি আইনি নোটিশ পাঠান তরুণী।
ওই নোটিশে পাঁচ দিনের মধ্যে ড. আফতাবকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। এবারো তিনি চিঠির জবাব না দেয়ায় ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসে ফেসবুক লাইভে এসে পুরো ঘটনা তুলে ধরেন তরুণী। ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর জেলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং ড. আফতাব এরআগেও এভাবে অনেককে নিপীড়ন করেছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। তার বিচারের দাবিতে ওই বছরের ১২ মার্চ নোয়াখালী শহরে মানববন্ধন করেন স্থানীয় বাসিন্দা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সংস্কৃতিকর্মীরা।
ওই তরুণী জানান, ১৪ মার্চ তিনি ওই কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির কাছে চিঠি পাঠিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেও সাড়া পাননি। পরে ২৮ মার্চ স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করে এ ঘটনার বিচার চেয়ে শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি জমা দেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তরুণীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অধ্যক্ষ ড. আফতাবের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে। পরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের কুমিল্লা অঞ্চলের পরিচালকের তদন্ত প্রতিবেদনের পর অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে প্রচলিত বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগকে (বেসরকারি কলেজ-৬ শাখা) অবহিত করার জন্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দিয়ে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছেন সিনিয়র সহকারী সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রনি চাকমা।
এদিকে ওই বছরের ১৯ জুন নোয়াখালী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ নির্যাতিত তরুণী (২৯) বাদী হয়ে অধ্যক্ষ ড. আফতাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা (নম্বর-৩৫৯) দায়ের করেন। মামলায় তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার তথ্য প্রমাণসহ উপস্থাপন করেন। আদালত নোয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) দীপক জ্যোতি খীসাকে অনুসন্ধানের জন্য দায়িত্ব দেন। দীপক জ্যোতি খীসা জানান, সরেজমিনে অনুসন্ধান, সাক্ষীদের জবানবন্দি, বাদীর উপস্থাপিত রেকর্ডপত্রসহ সিডি অডিও রেকর্ডিং পর্যালোচনা এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় বিবাদী আফতাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আদালতে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
এদিকে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ প্রথমে যৌন হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করে কলেজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একটি পোস্টের মাধ্যমে তার ছাত্রছাত্রীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। পরে নোয়াখালী জেলা জজ প্রথম আদালতে ওই তরুণীর বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার মানহানির মামলা করেন। সেই মামলার সমন পেয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে এর জবাব দিয়েছেন তরুণী। সেটি এখন শুনানির জন্য রয়েছে।
এ ব্যাপারে নোয়াখালী নারী অধিকার জোটের সভাপতি লায়লা পারভীন বলেন, মেয়েটি দ্বারে দ্বারে ঘুরেও বিচার না পেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ায় উল্টো তাকে হয়রানি করা হচ্ছে। এমনভাবে চলতে থাকলে যৌন হয়রানি আরও বাড়বে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, ২০০৮ সালে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেয়া পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ফোনে যৌন হয়রানিকে আইনের আওতায় আনা হয় এবং তা যৌন হয়রানি বলে চিহ্নিত করা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশনায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী নিপীড়ন সংক্রান্ত বিষয় দেখভাল করতে একটি ‘কমপ্লেইন কমিটি’ থাকার কথা থাকলেও নোয়াখালী সায়েন্স অ্যান্ড কমার্স কলেজে এমন কোনো কমিটি নেই।
নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নোয়াখালী সায়েন্স অ্যান্ড কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ ড. আফতাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগটি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর গঠিত তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ আফতাব উদ্দিনের বক্তব্য জানতে চাইলে শুক্রবার (১৩ আগস্ট) টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। আপনারা আদালত থেকে তথ্য নিতে পারেন।’