শোষিত ও অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালি জাতিকে মুক্তির দ্বার প্রান্তে এনেছিল যে বিশ্ব বরেন্য বীর পুরুষ,যিনি ছিলেন নির্যাতিত- নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা। বাঙ্গালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি ,বাঙ্গালি জাতির মুক্তির সনদ দাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৫ ই আগস্ট নিষ্ঠুর রাজনৈতিক হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃনিত,নিন্দিত ইতিহাসের ই চরম স্বাক্ষী।
বাঙ্গালির ৭ জন কলঙ্কিত সন্তান লে:কর্নেল রশিদ,লে: কর্নেল ফারুক,মেজর পাশা,মেজর হুদা,মেজর মহি উদ্দিন এবং পদচ্যুত মেজর ডালিম ও মেজর শাহরিয়ার সাথে স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক ব্যক্তিদ্বয়ের ঘৃনিত লালসাই এই হত্যাকান্ড সূচনা করে। ১৫ ই আগস্ট যে বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন উৎসবে যোগ দেওয়ার কথা ছিল, সে উৎসব কালো মেঘের শোকে পরিনত হল। ১৫ ই আগস্ট রাতেই তিনপুত্র সন্তান,পুত্রবধু,স্ত্রী ,নিকট আত্মীয় পরিজনসহ সবাইকে ঘৃনিত ঘাতকেরা নির্মমভাবে হত্যা করে।এই হত্যা বাঙ্গালির লালিত স্বপ্নকে হাজার বছর পিছিয়ে দেয়।রাজনৈতিক কারনই এই হত্যার পিছনে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তাঁর ই রাজনৈতিক সহকর্মিরা যে গুজব ছড়িয়ে ছিল বঙ্গবন্ধু দেশকে লুটেপুটে খাচ্ছেন তা নিতান্তই মিথ্যা ছিল।
কারন ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরনের পর ধানমন্ডি ৩২ নং থেকে যে মালামাল পাওয়া যায় তা হলো স্বর্নালংকার যার বাজার মূল্য প্রায় ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা।এই স্বর্নালংকার পৈতৃক সূত্রে কিংবা পুত্র বধুদের বিবাহের উপহার স্বরুপ পেয়েছিলেন বলে ও কথিত আছে।বাংলাদেশী মুদ্রায় নগদ ৯৪ হাজার ৪ শত একষট্টি টাকা।ব্যক্তিগত মোটর গাড়ি ৩ টা, বৈদাশিক মুদ্রা সতের হাজার পাঁচশত টাকা,বিদেশী রাষ্ট্র প্রদত্ত এক লাখ টাকার উপহার।বাতিলকৃত শতকী নোট ছয়শত একুশখানা।( তথ্য সূত্র- দৈনিক ইত্তেফাক,৩০ শে অক্টোবর ১৯৭৫) ।উপরের তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায় ৯৪ হাজার পাঁচশত টাকা ছাড়া বাকি মালামাল সমুহ নিতান্তই পারিবারিক সম্পদ কিংবা উপহার বৈ আর কিছুই নয়।
অন্যদিকে ৯৪ হাজার টাকা যা পাওয়া গিয়েছিল তা চার বছর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন কারী ব্যক্তির বাসায় থাকাটা অসম্ভব ও অস্বাভাবিক কিছু ছিলনা। এতদসত্বেও যাদের মিথ্যা প্ররোচনায় ৭ কোটি বাঙ্গালির স্বপ্নের ফুল বুট জুতোয় থেথলে গেল তাদেরকে জাতির নিকৃষ্ট কুলাংগার বলা অন্যায় হবে কী? বঙ্গবন্ধুর হত্যার পিছনে রাজনৈতিক ভূমিকাই যে মূখ্য ছিল তার আর কিছু নমুনা হল
ক• ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানি এটিকে “ঐতিহাসিক পদক্ষেপ” অাখ্যায়িত করিয়া বিদ্রোহীদের অভিনন্দন জ্ঞাপন করেছিলেন(তথ্য- ৩০ শে অক্টোবর ১৯৭৫,দৈনিক ইত্তেফাক) ।
খ• ভারতীয় সরকারি মুখপাত্র ১৫ ই আগস্ট হত্যাকান্ড সম্পর্কে বলেছিলেন প্রতিবেশি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবর্তনের গতিধারার প্রতিক্রিয়া আমাদের উপর না হওয়ার কোন অবকাশ নেই কিন্তু এইগুলি বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলিয়া অভিমত প্রকাশ করেন।( তথ্য- ১৭.০৮.১৯৭৫,বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকা)।
গ• ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর বাংলাদেশের ক্ষমতা পাওয়ার আশায় ৪০ জনের অধিক সংসদ সদস্য এবং টাংগাইলের গভর্নর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সীমান্ত অতিক্রম করিয়া সেদিন ভারতে গিয়েছিলেন।( তথ্য- জাতীয় রাজনীতি,অলি আহাদ,পৃষ্ঠা-৪৯৪) ।
ঘ• ১৫ ই আগস্ট ১৯৭৫ সালের পর খন্দকার মোশাররফ আহমদ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ছিলেন।বঙ্গবন্ধুর হত্যার ঐ দিনই তিনি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষন দিয়ে বলেছিলেন- এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের সঠিক ও সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপদানের পূত-পবিত্র দায়িত্ব সামগ্রিক ও সামষ্টিগতভাবে সম্পাদানের জন্য পরম করুনাময় আল্লাহ তায়ালা ও বাংলাদেশের গনমানুষের পক্ষ থেকে আমার উপর রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।( তথ্য- জাতীয় রাজনীতি, অলি আহাদ,পৃষ্ঠা- ৪৯৫) ।
ঙ• বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনীতিতে যোগদানের জন্য বামপন্থী নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ এক সময় যে শেখ মুজিবুর রহমানকে “মহাননেতা বঙ্গবন্ধু ” বলে সম্বোধন করেছিলেন সে হাজী দানেশ ই ১৫ আগস্ট হত্যা কান্ডের পর ৪ ঠা সেপ্টম্বর ১৯৭৫ সালে দেওয়া বিবৃতিতে বলেছিলেন “এক ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে চলছিল, উহা নস্যাৎ করিয়া দেওয়ার জন্য দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি অভিনন্দন।
চ• ৬ ই নভেম্বর ১৯৭৫ সালে বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি হয়ে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষনের মাঝামাঝিতে বলেন-” গত ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ কতিপয় অবসর প্রাপ্ত এবং চাকুরিরত সামরিক অফিসার এক বিপ্লবের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে হত্যা করে। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনার সাথে সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা ছিলনা ” উপরের ঘটনাতে রাষ্ট্রপতি সায়েম সামরিক বাহিনীকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন অথচ ঐ সময়কালের সেনা প্রধান কে. এম সফি উল্লাহ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামের ইতিহাস বিভাগের এক অনুষ্ঠানে প্রশ্নত্তোর পর্বে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর হত্যার আনুমানিক ৪৫ মিনিট আগে বঙ্গবন্ধু তাকে সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ টেলিফোনে দিয়েছিলেন।তাহলে রাষ্ট্রপতি সায়েমের বক্তব্য বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে ‘ সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা ছিল না’ এটি সত্য ভাষন ছিল না নি:সন্দেহে।
ছ• বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে বৈশ্বিক রাজনীতি ও সংযুক্ত ছিল।বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা থাকার সময় প্রানান্তর চেষ্টার পরও চীন ও সউদী আরব বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যার ১৫ দিন পর ৩০ শে আগস্ট ১৯৭৫ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই তার বার্তায় বলেন- চীন সরকার আজ থেকে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সর সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।
উপরের আলোচনা বিশ্লেষনে তথ্য,তত্ত্ব ও যুক্তির বানে প্রমান হল নিষ্ঠুর রাজনীতির খেলায় ই বঙ্গবন্ধু শাহাদাত বরন করেন।দেশীয় ও বিদেশীয় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র সাথে বিপদগামী সেনা সদস্যদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদেই এক হাজার একশত সাতটি শব্দের ১৯ মিনিটের কালজয়ী ভাষনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ গড়ে দেওয়ার কারিগর, পয়েট অব পলিটিক্স খ্যাত বঙ্গবন্ধু শাহাদাত বরন করেন।আজ ৪৪ তম শাহাদাত বার্ষিকীতে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করছি।
ফিরোজ আলম
প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান,আয়েশা( রা:) মহিলা কামিল(অনার্স,এম.এ) মাদ্রাসা,সদর,লক্ষীপুর।
সাধারন সম্পাদক , লক্ষীপুর জেলা শাখা এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি,বিএমজিটিএ ।