পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় হাইকোর্ট বলেছেন, এটাকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না, এটা অবহেলা। এর দায় কাউকে না কাউকে নিতে হবে। একজন দায়িত্বশীল আরেকজনের ওপরে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন, এটা ঠিক না। দেশের অর্থনীতির অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা ভাব-মর্যাদা নষ্ট করে দিচ্ছে।
অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে হাইকোর্ট আরও বলেন, আগুনে মানুষ পুড়ে মরে, তা হলে সিটি করপোরেশন কী করে? শুধু আন্তরিক হলে হবে না; কাজও করতে হবে। নিমতলীর ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির যে সুপারিশ ছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন হলে চকবাজারে এ দুর্ঘটনা ঘটত না।
বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সোমবার পৃথক তিনটি রিটের শুনানিতে এসব কথা বলেন।
চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ, কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণসহ কয়েক দফা নির্দেশনা চেয়ে গত রোববার এই রিটগুলো করা হয়। রিটে ২০১০ সালে রাজধানীর নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৩ জনের প্রাণহানির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির ১৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নেরও নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। পৃথক রিটগুলো করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ, নুর মোহাম্মদ আলী, খন্দকার মো. সায়েদুল কাউছার ও সাগুফতা তাবাসুসম।
আদালতের রিট আবেদনগুলোর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অমিত তালুকদার ও মো. রিয়াজ উদ্দিন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
শুনানির শুরুতেই রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার সময় চেয়ে আবেদন করেন। এ সময় সরকার অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলায় খুব আন্তরিক বলেও জানান তিনি। তখন আদালত সিটি করপোরেশনকে সতর্ক করে বলেন, শুধু আন্তরিক হলে হবে না। এ জন্য প্রয়োজনীয় কাজও করতে হবে।
এ সময় নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখ করে আদালত বলেন, নিমতলীর আগুনের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী দুই বোনকে দত্তক নিয়েছিলেন।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ সময় বলেন, সরকার এ ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। জবাবে আদালত বলেন, আন্তরিক হলে লাভ নেই। মানুষ তো চলে গেছে। কাজ তো করতে হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য তুলে ধরে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজেই চকবাজারের ঘটনা তদারকি করেছেন। এ সময় বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, উনি তো একা দেশ চালাতে পারবেন না। সুপারিশ (নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ড) বাস্তবায়নে সংশ্নিষ্ট প্রশাসনেরও দায়িত্ব রয়েছে। আদালত আরও বলেন, ওই সব এলাকার বাড়ির মালিকরা তিন গুণ বেশি টাকায় গোডাউন ভাড়া দেন। আর নিজেরা থাকেন গুলশানে। মারা যায় গরিব মানুষ। সিটি করপোরেশন দেখেও না দেখার ভান করে। যারা রাস্তায় মারা গেল, তাদের কী দোষ?
নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া ১৭ দফা সুপারিশের উল্লেখ করে আদালত বলেন, পত্রিকায় দেখেছি, সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এটা বাস্তবায়ন করা তাদের দায়িত্ব ছিল। জানি না তারা কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি-না। না নিলে ধরে নিতে হবে, তাদের অবহেলা ছিল।
আদালত আরও বলেন, পুরান ঢাকার রাস্তা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও যেতে পারে না। ৫ থেকে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে না হয় কিছু হবে না। কিন্তু ৭ থেকে ৮ মাত্রায় ভূমিকম্প হলে কোনো বিল্ডিং থাকবে না। এ ধরনের ভূমিকম্প হলে কাউকে উদ্ধার করারও কেউ থাকবে না।
এ সময় রিটকারীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল আদালতকে বলেন, নিমতলীর ঘটনায় কমিটি যে সুপারিশ করেছিল, তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় চকবাজারের ঘটনা ঘটেছে। তিনি কোর্টকে এ বিষয়ে শুনানি গ্রহণের আবেদন জানান। আইনজীবী বলেন, এ কাজে সরকারকে সম্পৃক্ত না করলে সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে না। তখন আদালত বলেন, আমরা তো সরকারের বক্তব্য শুনতে চাই। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সময় চেয়েছেন। আপনারা সবগুলো রিট একসঙ্গে করে নিয়ে আসেন। মঙ্গলবার শুনানি গ্রহণ করা হবে।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুরান ঢাকা চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় ৬৭ জন নিহত হন। আহত হন অর্ধশতাধিক। এখনও বেশ ক’জন আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।